ঘড়িতে তখন দুপুর ৩টা ৩০। পড়াতে গিয়েছি এক বাসায়। গিয়ে দেখলাম পুরো ঘর-দোড় অগোছালো । আমাকে দেখেই ছাত্র ইতস্তত বোধ করতে লাগলো। এবং জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো । আমি জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে?
ছাত্র বলল: স্যার আজ সকাল থেকেই ছোট ভাই রাজু খুব দুষ্টামি করছে । কারো কথাই শুনছে না ।
একটু দূরেই ছোট্ট রাজুকে ফ্লোরের মধ্যে গড়াগড়ি করতে দেখলাম। পুরো হাত-পায়ে ধুলো লেগে আছে। কথা যে সত্য তা বুঝতে পারলাম । উপায়ান্তর না দেখে রাকিবকে অভয় দিয়ে বললাম,
ঠিক আছে, তুমি দ্রুত এগুলো গুছিয়ে আসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি ।
আমি পড়ার ঘরে গিয়ে বসলাম। রাকিব দশম শ্রেণীতে পড়ে। ওরা দুই ভাই এবং এক বোন। রাকিবের বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ওর মা বিদ্যুৎ বিভাগে ভালো একটি পদে চাকরি করে। বাবা-মা দুজনেই সকাল আটটা থেকে পাঁচটা ডিউটি করেন। রাকিবের মা যেহেতু বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করেন, তাই কখনো কখনো তার ডিউটি বিকাল ৫.০০টা থেকে বেড়ে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত চলে। আমি আশ্চর্য হই এত লম্বা সময় রাকিবরা তিন ভাইবোন কিভাবে বাসায় একা থাকে। কেবল একজন বয়স্কা বুয়া থাকে ওদের রান্নাবান্না দেখাশোনার জন্য।…
চিন্তা করতে করতে স্টুডেন্ট চলে এসেছে। গোমরা মুখখানা দেখে আবার জিজ্ঞেস করলাম,
কি হয়েছে? পুরো ঘটনা বলো।
ছাত্র বলল, স্যার! খালা (মানে বুয়া ) যা রান্না করে তা আমরা ঠিকমতো খেতে পারি না। কোনদিন প্রচুর ঝাল আবার কোনদিন লবণ হয়নি আবার কোনদিন খাওয়াই যায়না এমনভাবে রান্না করে। আমি কোন মতে কষ্ট করে খেলেও রাজু কিছুই খেতে চায় না। আর সকাল থেকেই না খেয়ে ওর মেজাজ আরো খিটখিটে হয়ে আছে।
ওর কথা শুনে আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। কলেজে আমাদের বন্ধুদের কাছে মেসের বুয়াদের জঘন্য রান্নার কত গল্প যে আমরা শুনি তা উল্লেখ করার মতো না। মেসে থেকে একদিন খায় তো আরেকদিন না খেয়ে থাকে। আমার বন্ধুরা ওদের মায়ের রান্নার কত যে প্রশংসা করে! আসলে নিজের না হলে কেউ যত্ন করে কোন কিছু করতে চায় না। আর বুয়ারা যেনতেনো রান্না করেই দায়িত্ব সারে। সেই অখাদ্য বড়রাই ঠিকমতো খেতে পারে না। আর ওরা তো ছোট ।
বললাম: তাহলে বুয়া পরিবর্তন করো না কেনো ?
ছাত্র বলল: স্যার। নিরাপদ বোধ করেনা।
এবার বুঝলাম বুয়াও বুঝতে পেরেছে, তাকে ছাড়া তারা অচল । তাই বুয়াও তার মন মর্জি মত চলে ।
পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে এভাবে রাজু কতদিন না খেয়ে থাকবে?
রাকিব বলল: স্যার কিছুক্ষণের মধ্যে খালার(বুয়ার) মাইর খেয়ে তারপর খাবে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বুয়া ওর গায়েও হাত তোলে!
রাকিব: কি করবে স্যার! নয়তো খাবেই না।
আমি: তোমার মা বাবা এসব জানে?
রাকিব: জানে স্যার।
মা;বাবা উভয় চাকরিজীবী এমন পরিবারের ছেলেমেয়েরা কতটা অবহেলা শিকার হয় তা ভেবে অবাক লাগছে।
একদিন রাকিবের কাছে পানি খেতে চাইলাম। ছাত্র আমাকে এক গ্লাস এনে দিলো। গ্লাস মুখের সামনে আনতেই আমার বমি আসার মত অবস্থা! এমন বাজে খাবারের আঁশটে গন্ধ গ্লাসের মধ্যে!
বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
বুয়া কি তোমাদের গ্লাসগুলো ঠিকমতো ধোয় না?
স্টুডেন্ট মন খারাপ করে বলল: স্যার! গ্লাস ধুলেও বিপদ না ধুলেও বিপদ । গ্লাস যেদিন ধোয়, সেদিন সাবানের গন্ধে খেতে পারি না। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে এত পরিমাণ সাবান দেয় যার গন্ধে খাওয়া কষ্টকর। তবে স্যার এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। শুধু ছোট ভাইয়ের একটু সমস্যা হয়।
বাচ্চাদের প্রতি এমন অবহেলা সত্যিই বেদনাদায়ক। তাই মনে মনে সুযোগ খুঁজতে লাগলাম কিভাবে রাকিবের মায়ের সাথে কথা বলা যায়
একদিন ছুটির দিনে যখন পড়াতে গেলাম, তখন রাকিবের মায়ের সাথে দেখা হলো। বিভিন্ন আলোচনার মাঝে বুয়ার আচরণের কথা উল্লেখ করলাম। সে অত্যন্ত দুঃখের সাথে এ বিষয়গুলো জানেন বলে স্বীকার করলেন। কিন্তু তাদের হাতে বিকল্প অপশন না থাকায় কিছুই করতে পারছেন না। বুয়া সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত সময় দেয়। তাও অনেক বছর যাবত থাকে বিধায় নতুবা নতুনরা এত সময় দিবে না। আর তাছাড়া নিরাপত্তার সমস্যা তো রয়েছেই।
আক্ষেপ করে তিনি অতীতের অনেক কথা আমার সাথে শেয়ার করলেন। একটা সময় তাদের অনেক অভাবের সংসার ছিল যার কারণে বাধ্য হয়েই সন্তানের ভবিষ্যতের পড়ালেখার খরচ ও সুন্দর জীবনের কথা চিন্তা করে তিনি চাকরিতে যোগ দেন। এখন তিনি অনেক টাকা ইনকাম করেন সত্য কিন্তু সন্তানদের প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও সন্তানদের জন্য তিনি সময় পর্যাপ্ত পান না।
আমি মনে মনে তখন ভাবলাম, আহ টাকা! এটা কি সুখ নাকি ধোঁকা! বাজারের সবচেয়ে ভালো ভালো জিনিসগুলো বাজার থেকে তাদের ঘরে আসলেও, তার তিন সন্তানেরা সেগুলো ভালোভাবে খেতে পারেনা। ওরা তিন ভাই বোন যেমন রোগা পাতলা ও মানসিকভাবে অসুখী এর চেয়ে বোধ হয় গরিব ঘরের ছেলেমেয়েগুলো কম খাবারেও বেশি সুখী